top of page

স্পেনের গোল্ডেন ভিসা প্রোগ্রামের অবসান: ১২ বছরের যাত্রার শেষ এবং ভবিষ্যতের বার্তা

বিশ্বব্যাপী অভিবাসন নীতির পরিবর্তনশীল গতিপ্রবাহে সম্প্রতি স্পেন একটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে তাদের বহুল আলোচিত ও সমালোচিত "গোল্ডেন ভিসা" বা "ইনভেস্টর ভিসা" প্রোগ্রাম। ১২ বছর আগে চালু হওয়া এই স্কিমটি মূলত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সহজ আবাসন সুবিধা ছিল, যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের বিনিময়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (EU) একটি সদস্য রাষ্ট্রে বসবাসের অনুমতি এবং শেনজেন অঞ্চলে অবাধ চলাচলের সুযোগ দেওয়া হতো।


কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রোগ্রাম যেমন স্পেনের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে, তেমনি তা কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে, বিশেষত দেশের আবাসন বাজারে।

গোল্ডেন ভিসা

এই ব্লগে আমরা আলোচনা করব এই প্রোগ্রামের সূচনা, সফলতা, সমস্যাবলী এবং বন্ধের পেছনের কারণগুলো, যা বর্তমান বৈশ্বিক অভিবাসন ও বিনিয়োগ কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।


গোল্ডেন ভিসা প্রোগ্রাম: কী ছিল এর মূল উদ্দেশ্য?


২০১৩ সালে ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে স্পেন সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে এই ইনভেস্টর ভিসা প্রোগ্রাম চালু করে। মূল লক্ষ্য ছিল বিদেশি মূলধন প্রবাহ বাড়ানো এবং স্থবির হয়ে পড়া আবাসন খাতকে পুনরুজ্জীবিত করা।


প্রধান শর্তাবলি


➡‍€৫০০,০০০ বা তার বেশি পরিমাণ অর্থ স্পেনের আবাসন খাতে বিনিয়োগ করা লাগতো।


➡বিনিয়োগকারী ও তাদের পরিবার স্পেনে বসবাস করতে পারতেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি ও নাগরিকত্বের পথ খুলে যেত।


➡পাশাপাশি তারা শেনজেন ভুক্ত দেশগুলোতে ভিসা ছাড়াই চলাচল করতে পারতেন।


এই প্রোগ্রামের আওতায় ২০১৩ থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৪,৫৭৬টি গোল্ডেন ভিসা ইস্যু করা হয়।


সাফল্যের দিকগুলো: অর্থনৈতিক অবদান


গোল্ডেন ভিসা প্রোগ্রাম স্পেনের অর্থনীতিতে কিছু উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে:


১. আবাসন খাতের পুনরুদ্ধার


২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর স্পেনের রিয়েল এস্টেট বাজার ধসে পড়ে। গোল্ডেন ভিসা চালুর ফলে উচ্চমূল্যের আবাসনের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং নির্মাণ খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।


২. বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি


বেশিরভাগ বিনিয়োগই এসেছিল চীন, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং ল্যাটিন আমেরিকা থেকে। ইউরোপে পা রাখার একটি দরজা হিসেবে এই প্রোগ্রাম ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়।


৩. অভিজাত অভিবাসন বৃদ্ধি


ধনাঢ্য পরিবারগুলো স্পেনে চলে আসার ফলে তাদের ভোগ্যপণ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়ে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে সহায়ক হয়।


সমস্যাগুলো: কেন সমালোচনার মুখে পড়ে প্রোগ্রামটি?


যদিও প্রোগ্রামটি আর্থিকভাবে লাভজনক ছিল, তবে সময়ের সঙ্গে এর নেতিবাচক দিকগুলো স্পষ্ট হতে থাকে।


১. আবাসন খাতের অস্থিরতা


বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অভিজাত এলাকা ও উচ্চমূল্যের ফ্ল্যাট/ভিলা কিনে ফেলতে থাকায় স্থানীয়দের জন্য আবাসনের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য বাসস্থান সংকট দেখা দেয়।


২. ভূ-সম্পত্তির বাণিজ্যিকীকরণ


বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ শুধু ভিসা পাওয়ার জন্য ফ্ল্যাট কিনতেন এবং তাতে থাকতেন না। অনেক শহরে 'ঘোস্ট অ্যাপার্টমেন্ট' দেখা যেতে শুরু করে, যেখানে ঘর রয়েছে কিন্তু লোকজন নেই।


৩. দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের সম্ভাবনা


বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের কিছু বিতর্কিত ধনীদের এই ভিসা পাওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠে আসে— এই প্রোগ্রাম কি কালো টাকার সাদা করার একটি মাধ্যম হয়ে উঠছে?


বন্ধের সিদ্ধান্ত: কেন এখন?


স্পেন সরকার ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেয়। সরকার জানায়, এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আবাসন বাজারে যেভাবে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে, তা সহনীয় নয়।


মূল বিবেচ্য বিষয়


সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা: সরকারের মতে, নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা (বাসস্থান) বিনিয়োগকারীদের লাভের জন্য উৎসর্গ করা যাবে না।


আবাসন নীতিতে সংস্কার

স্পেন সরকার এখন আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক আবাসন নীতি গ্রহণ করতে চায়, যা স্থানীয় জনগণের জন্য সহায়ক হবে।


ইইউ চাপ

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও দীর্ঘদিন ধরে চাপ আসছিল এই ধরনের প্রোগ্রাম বন্ধ করার জন্য, কারণ এগুলো নিরাপত্তা ও বৈধতা ইস্যু তৈরি করছিল।


বিশ্বজুড়ে গোল্ডেন ভিসা

কোথাও প্রসার, কোথাও পতন

স্পেনের মতো প্রোগ্রাম কেবল তাদের দেশেই নয়, বিভিন্ন ইউরোপীয় ও উন্নত দেশে চালু রয়েছে বা ছিল। যেমন:


পর্তুগাল: ২০২3 সালে তারা রাজধানী লিসবনে গোল্ডেন ভিসা প্রোগ্রাম বন্ধ করে দেয় আবাসন সংকটের কারণে।


গ্রিস: এখনো প্রোগ্রাম চালু রয়েছে তবে শর্ত কঠোর করা হয়েছে।


মাল্টা ও সাইপ্রাস: নাগরিকত্ব ভিত্তিক বিনিয়োগ প্রোগ্রাম নিয়েও তারা বিতর্কে পড়ে।


তবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যও সময়ের সাথে সাথে তাদের অভিবাসন প্রোগ্রামগুলো কঠোর করে তুলেছে।


ভবিষ্যতের বার্তা: বিনিয়োগ বনাম ন্যায়বিচার


স্পেনের এই সিদ্ধান্ত শুধু এক দেশের নীতিগত রূপান্তর নয়, বরং এটি বিশ্বব্যাপী একটি প্রবণতার প্রতিফলন। প্রশ্ন উঠছে— কেবল ধনী হলেই কি কারো নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত?


এই ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হচ্ছে


➡সরকারগুলো এখন ধনী-নির্ভর অভিবাসন নয়, বরং মানবিক, টেকসই ও সমতা-নির্ভর নীতির দিকে ঝুঁকছে।


➡নাগরিকদের মৌলিক অধিকার (যেমন আবাসন) যেন ধনীদের লোভের শিকার না হয়, সেজন্য নীতিতে পরিবর্তন জরুরি।


স্পেনের গোল্ডেন ভিসা প্রোগ্রাম একটি যুগান্তকারী অভিবাসন ব্যবস্থা ছিল, যা অর্থনীতিতে এক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো সামনে চলে আসে— বিশেষ করে আবাসন সংকট, সামাজিক অসাম্য এবং নৈতিক প্রশ্নবোধ। এসব বিবেচনায় স্পেন সরকার এর অবসান ঘটিয়ে একটি সাহসী ও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


এই পদক্ষেপ অন্যান্য দেশকেও উদ্বুদ্ধ করতে পারে অভিবাসন নীতিকে আরও মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য। কেবল অর্থ নয়, বরং একটি দেশের ভবিষ্যত, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং নাগরিক কল্যাণই হওয়া উচিত যে কোনো নীতির মূল লক্ষ্য।

Comments


Connect Us

Enhance your ability to seize opportunities in Europe by understanding accurate information at the right time.

Thanks for submitting!

© 2025 by Europe Bound.
All Right Reserved

bottom of page