বুলগেরিয়া ইইউভুক্ত দেশ হয়েও কেন ফরেন ওয়ার্কার আকর্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে
- Shimul Hossain

- Jun 11
- 3 min read
২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেনজেন অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করেছে। ইউরোপের অভ্যন্তরীণ সীমান্তে ভ্রমণ এবং বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে গঠিত এই অঞ্চলের সদস্য হওয়া মানে আন্তর্জাতিক পর্যটন, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের দিক দিয়ে অপার সম্ভাবনা উন্মোচিত হওয়া।

তবে শেনজেনের এই সদস্যপদ বুলগেরিয়াকে যে কেবল সুফল এনে দেবে, বাস্তবতা কিন্তু আরও জটিল। এই সদস্যপদ অর্জনের পরও দেশটি এক গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে—বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ এবং ভিসা প্রক্রিয়ায় জটিলতা। বিশেষ করে পর্যটন খাতে বিদেশি কর্মীর ঘাটতি এখন বুলগেরিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার শেনজেন সদস্যপদ: আশার আলো না বিভ্রম?
বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ার শেনজেন অঞ্চলের সদস্যপদ লাভ অনেকটা রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক জয়ের প্রতীক। তবে এই সাফল্যের আড়ালে কিছু কঠিন বাস্তবতা এখন সামনে চলে এসেছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বুলগেরিয়ার প্রশাসনিক কাঠামো এখনও উন্নয়নশীল পর্যায়ে আছে। ফলে আন্তর্জাতিক ভিসা প্রক্রিয়া ও বিদেশি কর্মী নিয়োগ ব্যবস্থায় অসংখ্য সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
বুলগেরিয়ায় বিদেশি শ্রমিকদের জন্য বিভ্রান্তিকর ভিসা প্রক্রিয়া
বুলগেরিয়ায় বর্তমানে বিদেশি শ্রমিকদের জন্য কাজের ভিসা পেতে ৩ মাস কিংবা তারও বেশি সময় লাগছে। এই দীর্ঘ সময়সীমা শুধুমাত্র আবেদনকারীকে নয়, নিয়োগকর্তাকেও হতাশ করে তুলছে। অনেক বিদেশি নাগরিক আবেদন জমা দিয়েও মাঝপথে তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন এই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে।
একজন হোটেল মালিকের বর্ণনা অনুযায়ী, মাত্র ৮০ জন কর্মীর জন্য প্রায় ১,০০০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট প্রস্তুত করতে হয়েছে। কল্পনা করা যায়, এই অতিরিক্ত কাগজপত্রের ঝামেলা কী পরিমাণ চাপ সৃষ্টি করে ব্যবসা পরিচালনার ওপর।
ব্যাংকিং ও প্রশাসনিক জটিলতা
ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার পাশাপাশি, বিদেশি কর্মীরা দেশটিতে প্রবেশের পরও নানা প্রশাসনিক ও ব্যাংকিং সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেককে কাজ শুরু করার আগেই বারবার বিভিন্ন অফিসে যেতে হচ্ছে কাগজপত্র দাখিল বা অনুমোদনের জন্য। এমনকি একটি সাধারণ ব্যাংক কার্ড পেতেও সময় লাগছে দুই মাস পর্যন্ত।
আইন অনুযায়ী, ১০০ জনের বেশি বিদেশি কর্মী থাকলে তাদের বেতন ব্যাংকের মাধ্যমে দিতে হয়। কিন্তু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার জটিলতা ও দেরির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান সময়মতো বেতন পরিশোধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে।
কেন তৈরি হচ্ছে এই সংকট?
বুলগেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ২.৮ মিলিয়ন ভিসা আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু বাজেট ঘাটতির কারণে নতুন কর্মী নিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী বুলগেরিয়ার ৮৫টি কনস্যুলেটে মাত্র ১০০ জন কর্মকর্তা এবং ৭০ জন টেকনিক্যাল সহকারী কাজ করছেন। এর ফলে ভিসা প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে, আর একে ঘিরেই তৈরি হয়েছে এই সংকট।
সমাধানের খোঁজে: কী করা উচিত?
পর্যটন খাতের নেতারা এবং অর্থনীতিবিদরা একমত যে, বুলগেরিয়ার ভিসা সিস্টেমে দ্রুত ও বাস্তবসম্মত সংস্কার আনা প্রয়োজন। ই-ভিসা চালুর প্রস্তাব ইতোমধ্যেই উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। একটি ডিজিটালাইজড সিস্টেম হলে যেমন ভিসা প্রসেসিং সহজ ও স্বচ্ছ হবে, তেমনি কমে আসবে প্রশাসনিক ব্যয় এবং সময়।
এ বিষয়ে বুলগেরিয়ার পর্যটনমন্ত্রী মিরোস্লাভ বরেশাশ জানিয়েছেন, প্রশাসনিক ও আইনি বাধা দূর করতে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। এই গ্রুপ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদেশি কর্মী নিয়োগে সহায়তা করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট: আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বুলগেরিয়ার অবস্থান
বর্তমানে ইউরোপে শ্রমবাজারে বিদেশি কর্মীর চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, পর্যটন, নির্মাণ ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বুলগেরিয়া যদি সময়োপযোগী সংস্কার না আনে, তাহলে এই সুযোগ অন্য দেশগুলো নিয়ে নিতে পারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বুলগেরিয়ার প্রতিযোগিতা কমে যাবে।
ভবিষ্যতের করণীয়
ই-ভিসা চালু: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভিসা আবেদন ও অনুমোদনের পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে নিয়ে আসা প্রয়োজন।
নতুন জনবল নিয়োগ: কনস্যুলেটগুলিতে পর্যাপ্ত কর্মকর্তা ও টেকনিক্যাল স্টাফ নিয়োগ জরুরি।
প্রশাসনিক সংস্কার: ব্যাংকিং, পুলিশ, অভিবাসন দপ্তর ইত্যাদি বিভাগের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে।
সরকারি-ব্যক্তিমালিকানা অংশীদারিত্ব: বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কিছু প্রশাসনিক কাজ আউটসোর্স করে গতি আনা যেতে পারে।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল: বিদেশি কর্মীদের জন্য বিশেষ ওয়ার্ক পারমিট জোন স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিরবিচারে কাজ করতে পারেন।
শেনজেন সদস্যপদ নিঃসন্দেহে বুলগেরিয়ার জন্য একটি বড় অর্জন। তবে এই অর্জনকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে বাস্তবভিত্তিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রশাসনিক দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রতা বিদেশি শ্রমিক নিয়োগে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে যদি দ্রুত সমাধান না করা হয়, তাহলে শুধু শ্রমবাজারই নয়, বুলগেরিয়ার সামগ্রিক অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিদেশি শ্রমিকদের অভাব শুধুমাত্র ব্যবসার ক্ষতি নয়, বরং দেশের উন্নয়নের গতিও থামিয়ে দেয়। তাই এখনই সময়—বুলগেরিয়া যেন "সদস্যপদের গর্ব" ছেড়ে "কর্মপরিকল্পনার বাস্তবতা"য় ফিরে আসে।
আপনি যদি ইউরোপের অভিবাসন ও আন্তর্জাতিক শ্রম বাজার সংক্রান্ত আরও এমন তথ্যবহুল বিশ্লেষণ পড়তে আগ্রহী হন, আমাদের ব্লগটি ফলো করুন এবং নিচে কমেন্ট করে আপনার মতামত জানান!
_edited.jpg)



Comments