top of page

বাংলাদেশিদের আয়ারল্যান্ডে এসাইলাম আবেদন: বাস্তবতা, প্রক্রিয়া ও সম্ভাবনার চিত্র

বর্তমান বিশ্বে অভিবাসনের ধরণ বদলে গেছে। আর এই পরিবর্তনের ধারায় বাংলাদেশিরাও পিছিয়ে নেই। উন্নত জীবনের আশায়, রাজনৈতিক নিপীড়ন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়ে বহু বাংলাদেশি পাড়ি জমাচ্ছেন ইউরোপের নানা দেশে। এর মধ্যে আয়ারল্যান্ডে এসাইলাম একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।

আয়ারল্যান্ডে এসাইলাম

এই ব্লগে আমরা জানবো কেন বাংলাদেশিরা আয়ারল্যান্ডে এসাইলাম চাইছেন, কীভাবে এই প্রক্রিয়া চলে, এবং কী বাস্তবতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।


📈 বাংলাদেশিদের এসাইলাম আবেদন: একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক চিত্র


২০২৩ সালে প্রায় ৫৫,৪১৭ জন বাংলাদেশি বিভিন্ন দেশে এসাইলামের জন্য আবেদন করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গন্তব্য দেশগুলো হলো ইতালি, ফ্রান্স ও কানাডা। ইউরোপে ২০২২ সালে আবেদনকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল ৩৩,৭৩১ জন, যেখানে ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭ হাজার।


আয়ারল্যান্ডে ২০১৪ সালে মাত্র ৯৯ জন আবেদন করেছিলেন, আর ২০২৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪৫ জনে। ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই দেশটিতে বাংলাদেশি এসাইলাম আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় ৪,৬৩৮।


ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EUAA) এক জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ফ্রান্সে প্রায় ২,৭৬০, ইতালিতে ১৮,৪০০ এবং আয়ারল্যান্ডে ১,৮৪০ জন বাংলাদেশি এসাইলামের জন্য আবেদন করেছেন।


🌍 কেন আয়ারল্যান্ডকেই বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা?


বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করছে। EUAA-এর ১৭৩ পৃষ্ঠার একটি বিশ্লেষণী রিপোর্টে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে এবং সরকারবিরোধীদের উপর দমন-পীড়ন বেড়েছে।


ফলে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধীদলের নেতা এমনকি সাধারণ নাগরিকরাও আইনি সুরক্ষার আশায় বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এসাইলামের আবেদনকারী অনেকেই এসব নির্যাতনের শিকার।


📝 এসাইলাম প্রক্রিয়া: ধাপ ধরে ধাপে


আয়ারল্যান্ডে এসাইলাম প্রক্রিয়াটি মোট ৬টি ধাপে সম্পন্ন হয়। চলুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক পুরো প্রক্রিয়াটি:


১. প্রথম ধাপ: আবেদন জানানো


বিদেশি নাগরিকেরা আয়ারল্যান্ডে ঢোকার সময়ই বিমানবন্দর বা সমুদ্রবন্দরে এসাইলাম আবেদন করতে পারেন। এছাড়া, International Protection Office (IPO)-তে সরাসরি গিয়েও আবেদন করা যায়।


২. দ্বিতীয় ধাপ: প্রাথমিক সাক্ষাৎকার


এখানে আবেদনকারীর পরিচয়, আগমনের পেছনের কারণ এবং স্বদেশে ফিরে না যাওয়ার যুক্তি বিশ্লেষণ করা হয়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবিও সংগ্রহ করা হয়।


৩. তৃতীয় ধাপ: প্রশ্নপত্র পূরণ


আবেদনকারীকে একটি বিশদ প্রশ্নপত্র পূরণ করতে হয় যা তার জীবনের প্রেক্ষাপট, ভয় এবং নিরাপত্তার ঝুঁকির বর্ণনা দেয়।


৪. চতুর্থ ধাপ: ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার


সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। একজন কেস অফিসার আপনার সাথে বিস্তারিতভাবে কথা বলবেন এবং আপনার বর্ণনা অনুযায়ী একটি রিপোর্ট তৈরি করবেন।


৫. পঞ্চম ধাপ: আইপিওর সুপারিশ


IPO যাচাই করে সুপারিশ প্রদান করবে — আপনি "Refugee" স্ট্যাটাস বা "Subsidiary Protection" পাওয়ার যোগ্য কিনা।


৬. ষষ্ঠ ধাপ: মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত


Ministry of Justice থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে IPO-এর সুপারিশই গৃহীত হয়।


⚠️ চ্যালেঞ্জ ও দীর্ঘ সময়


আয়ারল্যান্ডে এসাইলাম প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। অনেক সময় একেকটি আবেদন নিষ্পত্তি হতে ৪ থেকে ৬ বছর সময় লেগে যায়। গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কেউ কেউ ১৫-২০ বছর অপেক্ষার পর ফলাফল পেয়েছেন।


২০২৩ সালে বাংলাদেশিদের মধ্যে ৪৪৫ জন আবেদন করেছিলেন, যার মধ্যে মাত্র ১২ জনের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, গৃহীত হওয়ার হার মাত্র ১৪%।


🏘️ আবাসন ও সুযোগ-সুবিধা


আবেদন চলাকালে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা সংস্থা (IPAS) আবেদনকারীদের থাকার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাপ্তাহিক ভাতা €৩৮ এবং শিশুদের জন্য €২৯ প্রদান করা হয়। তবে, আবেদনকারীরা আবেদন জমার পর প্রথম ৫ মাস পর্যন্ত কোনো কাজ করতে পারেন না।


🤝 সহায়তাকারী সংগঠনসমূহ


আয়ারল্যান্ডে কিছু সংগঠন রয়েছে যারা এসাইলাম আবেদনকারীদের আইনি ও মানবিক সহায়তা প্রদান করে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল:


  • Irish Refugee Council (Dublin)

  • NASC (Cork)

  • Doras (Limerick)


📢 বিকল্পের অভাব: রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ইউরোপের ভূমিকা


বাংলাদেশের একনায়কতান্ত্রিক ধারার দিকে ধাবিত হওয়া এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর দুর্বলতা আন্তর্জাতিক মহলের নজর কেড়েছে। EUAA-র এক টুইট বার্তায় উল্লেখ করা হয় যে, ২০২২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত প্রায় ৯০,০০০ বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এসাইলামের আবেদন করেছেন।


আয়ারল্যান্ডে বাংলাদেশিদের এসাইলাম আবেদনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি এক গভীর রাজনৈতিক ও মানবিক সংকটের প্রতিফলন। জীবন বাঁচাতে, মৌলিক অধিকার রক্ষায় এবং মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার আশায় তারা এ পথ বেছে নিচ্ছেন।


তবে, এ পথ মোটেই সহজ নয়। দীর্ঘ সময়, জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় এবং মানসিক চাপে ভুগতে হয় অনেককে। ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ও মানবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়, তবে হয়তো আর কোনো বাংলাদেশিকে বিদেশে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে না।

Comments


Connect Us

Enhance your ability to seize opportunities in Europe by understanding accurate information at the right time.

Thanks for submitting!

© 2025 by Europe Bound.
All Right Reserved

bottom of page