গত চার বছরে ৪৩% স্টুডেন্ট ভিসা বৃদ্ধি: জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার সুবর্ণ সুযোগ
- Shimul Hossain

- Jun 4
- 3 min read
বর্তমানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রাসঙ্গিক গন্তব্যগুলোর একটি হচ্ছে জার্মানি। উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, বৈশ্বিক স্বীকৃত ডিগ্রি, তুলনামূলক কম খরচ, এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ভিসা নীতি—এই সব মিলিয়ে দেশটি আজ উচ্চশিক্ষার জন্য এক অনন্য স্থান হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে জার্মানিতে স্টুডেন্ট ভিসা (Student Visa) সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৩%। ২০২১ সালে যেখানে প্রায় ৬৩,০০০ শিক্ষার্থী জার্মানিতে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ভিসা পেয়েছিল, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০,০০০-এ। এই বিশাল বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে কিছু কৌশলগত নীতি, বিশ্ব পরিস্থিতি, এবং শিক্ষার্থীদের সচেতনতার অভাবনীয় বৃদ্ধি।

এই ব্লগে আমরা জানব:
কী কারণে এই ভিসা বৃদ্ধির হার এত বেশি?
কেন জার্মানি আজ শিক্ষার্থীদের জন্য এত আকর্ষণীয়?
কীভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষার্থীরা এই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারেন?
ভবিষ্যতে কী ধরনের প্রবণতা আশা করা যায়?
জার্মানিতে শিক্ষাভিসার চিত্র
জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের (Interior Ministry) তথ্যমতে, মাত্র তিন বছরে শিক্ষাভিসা ইস্যুতে ৪৩% বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০২১ সালে ইস্যু করা হয়েছিল ৬৩,০০০টি শিক্ষাভিসা। ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০,০০০। এই হিসেব অনুযায়ী, তিন বছরে প্রায় ২৭,০০০ বেশি শিক্ষার্থী জার্মানিতে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন।
এমন এক সময়ে এই বৃদ্ধি ঘটেছে যখন বিশ্বজুড়ে ভিসা পাওয়া দিনকে দিন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় কঠিনতর নীতিমালা চালু হওয়ায় শিক্ষার্থীদের নজর এখন জার্মানির দিকে ঘুরে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান সরকারের শিক্ষাবান্ধব ভিসা নীতি এক বড় ভূমিকা পালন করেছে।
কেন এত শিক্ষার্থী জার্মানিকে বেছে নিচ্ছেন?
১. নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা
জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগই আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম সারিতে। টিউশন ফি নেই বা খুবই কম, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সাথে উচ্চমানের গবেষণা সুবিধা এবং হাতে-কলমে শেখার ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় আকর্ষণ।
২. কম খরচে ইউরোপীয় শিক্ষা
যুক্তরাজ্য বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় জার্মানিতে শিক্ষার খরচ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বার্ষিক খরচ যেখানে ইউরোপের অন্যান্য দেশে ১৫,০০০ ইউরো থেকে শুরু, সেখানে জার্মানির অনেক শহরে ৮,০০০-১০,০০০ ইউরোর মধ্যেই থাকা ও পড়াশোনা সম্ভব।
৩. ইংরেজি-মাধ্যমে কোর্সের প্রাচুর্য
জার্মানিতে আজ অসংখ্য কোর্স ইংরেজি ভাষায় পড়ানো হয়, বিশেষ করে মাস্টার্স পর্যায়ে। ফলে জার্মান ভাষা জানার বাধ্যবাধকতা নেই অনেক ক্ষেত্রেই, যদিও জানা থাকলে তা বাড়তি সুবিধা দেয়।
৪. পড়াশোনার পর চাকরির সুযোগ
জার্মানিতে পড়াশোনা শেষে শিক্ষার্থীরা ১৮ মাস পর্যন্ত চাকরি খোঁজার অনুমতি পান। অনেকেই এই সময়ের মধ্যেই চাকরি পেয়ে যান এবং রেসিডেন্স পারমিটও পান। ফলে পড়াশোনার পর সোজা কর্মজীবনে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত।
৫. শক্তিশালী অর্থনীতি ও দক্ষ কর্মী চাহিদা
জার্মানি ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। বর্তমানে দেশটিতে দক্ষ কর্মীর অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদেরকে চাকরির বাজারে স্বাগত জানানো হচ্ছে।
জার্মান সরকারের সক্রিয় ভূমিকাই মূল চাবিকাঠি
জার্মান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যান্সি ফায়েজার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিনটি খাতে সরকার বিশেষ সাফল্য পেয়েছে:
দক্ষ কর্মীদের জন্য অভিবাসন সহজীকরণ
মানব পাচার প্রতিরোধ
অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ
বিশেষ করে দক্ষ কর্মীদের ক্ষেত্রে জার্মান সরকার অভিবাসন নীতিকে সহজ করেছে। উচ্চশিক্ষিত, প্রযুক্তিবিদ, স্বাস্থ্যকর্মী, এবং প্রকৌশলবিদদের জন্য আগের চেয়ে সহজে কাজ এবং রেসিডেন্স পারমিট পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একইসাথে অসৎ উদ্দেশ্যে দেশটিতে ঢোকা প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশীয় শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ সুযোগ
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ জার্মানির প্রতি বাড়ছে। কিছু কারণ:
IELTS/TOEFL স্কোর থাকলে সহজে ইংরেজি-মাধ্যমে ভর্তি
ভার্সিটির আবেদন পদ্ধতি তুলনামূলক সহজ
“APS সার্টিফিকেট” চালুর মাধ্যমে সিস্টেমকে স্বচ্ছ করা
প্রি-ভিসা ব্লকড অ্যাকাউন্ট ও ভিসা ইন্টারভিউয়ের সময় কমে আসা
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য “DAAD Scholarship” একটি বড় সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। প্রতি বছর অনেকেই এই স্কলারশিপের মাধ্যমে পুরো খরচ ছাড়াই পড়াশোনা করতে পারছে।
ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া
জার্মান সরকার ভিসা প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছে। অনলাইন আবেদন, দ্রুত সাক্ষাৎকারের তারিখ পাওয়া এবং ডকুমেন্ট যাচাইয়ের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এসেছে।
তবে কিছু বাস্তবতা খেয়াল রাখতে হবে:
ভিসার জন্য ব্লকড অ্যাকাউন্টে নির্ধারিত অর্থ থাকতে হবে (২০২৪-এ প্রায় ১১,০০০ ইউরো)
APS সার্টিফিকেট পেতে কিছুটা সময় লাগে, তাই আগে থেকেই পরিকল্পনা জরুরি
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত না হলে ভিসা পাওয়া সম্ভব নয়
ভবিষ্যতের প্রবণতা
বিশ্লেষকদের মতে, জার্মানির শিক্ষাভিসা বৃদ্ধির হার আগামী ৫ বছরে আরও বাড়বে। কারণ:
জার্মানির জনসংখ্যা বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছে, ফলে কর্মশক্তির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে
দেশটির অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে শিক্ষিত বিদেশিদের প্রয়োজন
সরকার নতুন নতুন ভিসা প্রোগ্রাম চালু করছে (যেমন Opportunity Card)
এছাড়া, “Blue Card” সুবিধার মাধ্যমে উচ্চ বেতনের চাকরিতে ঢুকতে এখন আরও সহজ।
কিছু পরামর্শ ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের জন্য
যারা জার্মানিতে পড়তে যেতে আগ্রহী, তাদের জন্য কিছু জরুরি পরামর্শ:
➡️শুরু করুন এক বছর আগে থেকেই প্রস্তুতি: বিশ্ববিদ্যালয় খোঁজা, ভাষা পরীক্ষা, ফিনান্সিং, এবং ভিসা প্রক্রিয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় রাখুন।
➡️ভুল তথ্য এড়িয়ে চলুন: অনেক সময় ভুয়া এজেন্টের প্রতারণায় পড়া যায়। সব তথ্য DAAD বা সরকারি সাইট থেকে নিন।
➡️ভাষার উপর জোর দিন: জার্মান ভাষা শেখা পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি খোঁজার সময়ও সহায়ক হবে।
➡️নেটওয়ার্ক গড়ে তুলুন: বিভিন্ন স্টুডেন্ট ফোরাম, ফেসবুক গ্রুপ বা DAAD ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন।
এখনই সময় প্রস্তুতির
জার্মানিতে পড়াশোনার জন্য এখনই সবচেয়ে ভালো সময়। যেহেতু সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে, তাই দেরি না করে প্রস্তুতি শুরু করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। একদিকে উন্নত শিক্ষা, অন্যদিকে ভালো চাকরি—সব মিলিয়ে এটি হতে পারে আপনার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ বিনিয়োগ।
তাই, আপনার স্বপ্ন যদি হয় বিদেশে উচ্চশিক্ষা—তবে জার্মানি হতে পারে আপনার সেই স্বপ্নপূরণের প্রথম ধাপ। আর সেই পথে আজই পা রাখুন, কারণ সুবর্ণ সুযোগ বারবার আসে না।
_edited.jpg)



Comments